ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণ মূলত ভাইরাসের প্রভাব ও শরীরের প্রতিক্রিয়া। ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরের রক্তনালি এবং প্লাটিলেট উৎপাদনকারী অস্থিমজ্জা (bone marrow)-এর উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে প্লাটিলেট কমে যায়। কিছু প্রধান কারণ হলো:

- ভাইরাসের সরাসরি প্রভাব: ডেঙ্গু ভাইরাস প্লাটিলেটগুলির উপর সরাসরি আক্রমণ করতে পারে, যার ফলে প্লাটিলেট ধ্বংস হয়ে যায়।
- অস্থিমজ্জার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া: ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর অস্থিমজ্জা প্লাটিলেট তৈরি করতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলে প্লাটিলেট উৎপাদন কমে যায়।
- অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া: ডেঙ্গু ইনফেকশনের ফলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছু সময় নিজের প্লাটিলেটকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এগুলোর বিরুদ্ধে অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, ফলে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যেতে পারে।
- রক্তনালীর আংশিক ক্ষতি: ডেঙ্গু ভাইরাস রক্তনালীগুলির নরম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে রক্তপাতের হার বৃদ্ধি পায় এবং প্লাটিলেটের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।
এই কারণগুলির কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের প্লাটিলেটের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায়, যা কখনও কখনও ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের (DSS) মতো জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
এ কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্লাটিলেটের সংখ্যা মনিটর করা প্রয়োজন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে প্লাটিলেট কমে যাওয়ার আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। প্লাটিলেট হলো রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা রক্তপাত বন্ধ করার কাজে সাহায্য করে (হেমোস্ট্যাসিস)। ডেঙ্গু ভাইরাস এই প্রক্রিয়াতে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায় এবং রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এখানে কিছু বিশদ কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. ভাইরাসের আক্রমণ এবং প্লাটিলেট ধ্বংস
ডেঙ্গু ভাইরাস বিশেষভাবে প্লাটিলেট এবং রক্তের অন্যান্য কোষগুলোকে আক্রান্ত করতে পারে। ভাইরাস যখন শরীরে প্রবেশ করে, তখন এটি রক্তের বিভিন্ন কোষ, বিশেষ করে প্লাটিলেটের উপর আক্রমণ করে এবং তাদের ধ্বংস করতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভাইরাসের উপস্থিতি প্লাটিলেটের ঝিল্লী (membrane) বা সেল মেমব্রেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে তারা সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়।
২. অস্থিমজ্জার ওপর প্রভাব
অস্থিমজ্জা হলো শরীরের সেই অংশ যেখানে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়। ডেঙ্গু ভাইরাস এই অস্থিমজ্জার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে, ফলে নতুন প্লাটিলেটের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে শরীরে প্লাটিলেটের অভাব দেখা দেয়।
৩. অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া
ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্ররোচিত করতে পারে এবং এটি এক ধরনের অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে, শরীর নিজের প্লাটিলেটগুলোকে শত্রু মনে করে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে। এই অ্যান্টিবডিগুলো প্লাটিলেটগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে, যা প্লাটিলেটের সংখ্যা আরও কমিয়ে দেয়। এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের (DSS) কারণে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
৪. মাইক্রোস্কোপিক রক্তক্ষরণ এবং রক্তনালীর ক্ষতি
ডেঙ্গু ভাইরাস রক্তনালীগুলির দেওয়ালকে দুর্বল করে তোলে, যার ফলে ক্ষুদ্র রক্তপাত ঘটে। এতে প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে যায়, কিন্তু নতুন প্লাটিলেট তৈরি হতে না পারলে শরীরে রক্তক্ষরণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। প্লাটিলেটের অভাবের কারণে এই ক্ষতিসমূহ স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে পারে না এবং রোগী অধিক রক্তক্ষরণে ভুগতে পারে।
৫. বিভিন্ন ধরণের শক সিনড্রোম
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) একটি গুরুতর জটিলতা, যেখানে রক্তচাপ বিপদজনকভাবে কমে যায় এবং রক্তের প্রবাহ কমে যায়। এই অবস্থায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। এখানে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিবহন এবং কোষের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যা আরও জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
৬. ম্যালফাংশনিং লিভার ও স্লীনের প্রভাব
ডেঙ্গু ভাইরাস কখনও কখনও লিভার বা স্লীনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে, যা প্লাটিলেটের সঞ্চয় এবং ব্যবহার প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে। স্লীনে প্লাটিলেট কিছু সময়ের জন্য সঞ্চিত থাকে এবং রক্তে তাদের মুক্তির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ডেঙ্গু ভাইরাস এই প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত করতে পারে, যার ফলে প্লাটিলেট কমে যায়।
৭. ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এবং প্লাটিলেট কমে যাওয়ার সম্পর্ক
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার একটি গুরুতর অবস্থা যেখানে প্লাটিলেটের সংখ্যা একেবারে কমে যেতে পারে এবং রক্তপাত মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এই অবস্থায় শরীরের রক্তনালীগুলি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় এবং প্লাটিলেটের ভূমিকা যথাযথভাবে কার্যকর না হলে, রক্তক্ষরণের কারণে জীবন বিপদের মুখে পড়তে পারে।
৮. সাংগঠনিক প্লাটিলেট কমে যাওয়ার প্রক্রিয়া
ডেঙ্গুর কারণে প্লাটিলেটের কমে যাওয়ার একটি আরেকটি কারণ হলো শরীরের তাপমাত্রার ওঠানামা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যা রক্তনালীর প্রসারণ ঘটাতে পারে এবং এর ফলে প্লাটিলেটের সঞ্চয় ও কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসার জন্য গুরুত্ব:
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের প্লাটিলেটের সংখ্যা মনিটর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে প্লাটিলেটের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করতে হয়, এবং যদি প্লাটিলেটের সংখ্যা খুব কমে যায়, তবে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
উপসংহার: ডেঙ্গু ভাইরাসের ফলে শরীরের প্লাটিলেট কমে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে ভাইরাসের সরাসরি আক্রমণ, অস্থিমজ্জার ক্ষতি, অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া, রক্তনালীর ক্ষতি এবং অন্যান্য জটিলতা অন্যতম। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় মূল লক্ষ্য হলো প্লাটিলেটের সংখ্যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ করা।