থাইরয়েডের সমস্যা হলে কী খাবেন, কী খাবেন না

থাইরয়েডের সমস্যা হলে কী খাবেন, কী খাবেন না

Health-স্বাস্থ্য ব্লগ ওয়েব

থাইরয়েড হল আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা হরমোন নিঃসরণ করে এবং শরীরের বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। থাইরয়েড হরমোনের দুটি প্রধান ধরণ থাকে, T3 (থাইরক্সিন) এবং T4 (টেট্রাইওডোথাইরোনিন)। এই হরমোনগুলি শরীরের বিপাক কার্যক্রম, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, হৃদস্পন্দন এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি। থাইরয়েডের সমস্যা হলে, যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব) বা হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন), তা আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যকলাপের ওপর প্রভাব ফেলে। এই অবস্থায় সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

থাইরয়েড সমস্যা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

১. হাইপোথাইরয়েডিজম: থাইরয়েডের হরমোন উৎপাদন কমে গেলে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া স্লো হয়ে যায়, যার ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন: অবসাদ, ওজন বৃদ্ধি, শীতল অনুভূতি, চুল পড়া ইত্যাদি।

২. হাইপারথাইরয়েডিজম: থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন শরীরের বিপাক প্রক্রিয়াকে দ্রুত করে তোলে, যার ফলে অবসাদ, দ্রুত হৃদস্পন্দন, ঘাম বেশি হওয়া এবং অল্প খেলে ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

থাইরয়েডের সমস্যা হলে কী খাবেন

১. আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার: আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, খুব বেশি আয়োডিন গ্রহণও ক্ষতিকর হতে পারে, তাই প্রয়োজন অনুযায়ী মাত্রায় এটি গ্রহণ করা উচিত।

  • সামুদ্রিক মাছ: সামুদ্রিক মাছ, যেমন- স্যালমন, ম্যাকারেল, টুনা, এগুলো আয়োডিনের ভাল উৎস।
  • লবণ: আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করতে পারেন। তবে বেশি লবণ খাবার বিপাকের জন্যও ক্ষতিকর, তাই নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে এটি ব্যবহার করুন।

২. ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডি থাইরয়েডের সুস্থ কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি সূর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়, তবে খাদ্য থেকে এর কিছু পরিমাণও নেওয়া সম্ভব।

  • মাশরুম: মাশরুমে ভিটামিন ডি থাকে।
  • ফ্যাটি মাছ: স্যালমন, টুনা, এবং সারডিনে ভিটামিন ডি থাকে।
  • ডিম: ডিমের কুসুমেও ভিটামিন ডি রয়েছে।

৩. সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: সেলেনিয়াম থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন এবং কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।

  • আখরোট: আখরোট সেলেনিয়ামের একটি ভাল উৎস।
  • সানফ্লাওয়ার সিডস: এটি সেলেনিয়ামের উৎস হিসেবেও কাজ করে।
  • ব্রাজিল নাটস: এটি সেলেনিয়ামের সবচেয়ে ভাল উৎস।

৪. জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার: জিঙ্ক থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদনকে সমর্থন করে এবং শরীরের বিপাক প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে।

  • কুমড়োর বীজ: কুমড়োর বীজে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে।
  • মাংস: মাংসে, বিশেষ করে মুরগি ও গরুর মাংসে জিঙ্ক পাওয়া যায়।

৫. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর খাবার থাইরয়েডের সুস্থ কার্যক্রমে সহায়তা করে।

  • সবুজ শাকসবজি: পালং শাক, ব্রকলি, কেল, এই সব সবজি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর।
  • ফল: ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, আনারস, আপেল এসব ফল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ।

৬. প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার: প্রোবায়োটিক খাবার আমাদের পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, যা থাইরয়েডের সুস্থতায় সহায়তা করে।

  • দই: দই প্রোবায়োটিকের একটি ভাল উৎস।
  • কিমচি ও কেফির: এই ধরনের খাবারেও প্রোবায়োটিক রয়েছে।

থাইরয়েডের সমস্যা হলে কী খাবেন না

১. গোইট্রোজেনি জাতীয় খাবার: গোইট্রোজেন এমন পদার্থ যা থাইরয়েডের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

  • কলিফ্লাওয়ার: থাইরয়েডের সমস্যা হলে অতিরিক্ত কলিফ্লাওয়ার খাওয়া উচিত নয়।
  • ব্রকলি ও কপিফুল: এগুলোও গোইট্রোজেনযুক্ত খাবারের মধ্যে পড়ে। তবে, এটি রান্না করে খেলে কিছুটা ক্ষতি কমে যায়।

২. প্রসেসড ফুড: প্রসেসড ফুডের মধ্যে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত এবং ক্ষতিকর চর্বি থাকে, যা শরীরের বিপাক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

  • ফাস্ট ফুড: ফাস্ট ফুডে ট্রান্স ফ্যাট এবং অতিরিক্ত লবণ থাকে যা থাইরয়েডের কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
  • কেক, কুকিজ ও চিপস: এসব খাবারে প্রিজারভেটিভস, চিনিযুক্ত উপাদান থাকে, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

৩. সোডা ও সুগারি পানীয়: অতিরিক্ত চিনি থাইরয়েডের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা দিতে পারে। এতে শরীরের ইনসুলিন লেভেল বাড়ে, যা থাইরয়েডের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে।

  • কোল্ড ড্রিংকস: স্যাকারিন বা উচ্চ পরিমাণে চিনি যুক্ত পানীয়গুলি থাইরয়েডের জন্য উপকারী নয়।
  • সুপার সুগারি কফি ও চা: এগুলোও এড়ানো উচিত।

৪. অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন: অতিরিক্ত ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল থাইরয়েডের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

  • কফি: ক্যাফেইন শরীরে অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
  • অ্যালকোহল: অ্যালকোহল থাইরয়েডের কার্যক্রমকে কমাতে পারে এবং এড্রেনাল ফাংশনকে প্রভাবিত করতে পারে।

৫. গো-ডেট ফুড: কিছু খাবার, যেমন সয়া প্রোডাক্ট, বিশেষ করে টফু ও সয়া মিল্ক, থাইরয়েডের হরমোন উৎপাদনে বাধা দিতে পারে।

  • সয়া পণ্য: এগুলি থাইরয়েডের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে যাদের হাইপোথাইরয়েডিজম আছে।

উপসংহার

থাইরয়েডের সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য সঠিক খাবার নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে আয়োডিন, সেলেনিয়াম, ভিটামিন ডি এবং জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবারের ভূমিকা অপরিসীম। একইভাবে, গোইট্রোজেন, প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত চিনি ও ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত। খাদ্যাভ্যাসে সঠিক পরিবর্তন আনা শুধু থাইরয়েডের স্বাস্থ্য নয়, বরং সাধারণ স্বাস্থ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই, যেকোনো ধরনের থাইরয়েড সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা এবং নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *