যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন মোয়াজ্জেম, আচমকা ওপরে এসে পড়ে কনটেইনার

বাংলাদেশ

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজের আয়ের উৎস শখের মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন (৪০)। চার বছরের ছেলে লাব্বাইককে বলে গিয়েছিলেন আসার সময় তার জন্য কিছু নিয়ে আসবেন। তবে কথা রাখতে পারেননি মোয়াজ্জেম হোসেন। রাত ১০টার দিকে রাস্তার মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ সময় পাশেই তেলবাহী ওয়াগনের সঙ্গে একটি লরি ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে যায়। তখন লরির ওপর থাকা কনটেইনার মোয়াজ্জেমের ওপর পড়ে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম নগরের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

স্ত্রী-দুই সন্তান ও নিজের মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় নিজের চারতলা বাড়িতে থাকতেন মোয়াজ্জেম। একসময় মুদিদোকান ছিল তাঁর। পরে নিজের মোটরসাইকেল দিয়ে শুরু করেন রাইড শেয়ারিং। এ ছাড়া তিনটি রিকশাও ছিল। সেগুলো ভাড়ায় দিয়েছেন। এই আয়েই চলত তাঁর সংসার।

আজ শুক্রবার দুপুর ১২টায় নিহত মোয়াজ্জেমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বসার ঘরে নিজের প্রিয় গাড়ি নিয়ে খেলা করছে লাব্বাইক মোয়াজ্জেম। বাবা নেই এটা সে জানে না, আর জানলেও তার বোঝার কথা নয়। তবু আশপাশে সবার কান্না দেখে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করছে, ‘তোমরা কাঁদছ কেন?’ তবে বাবা আর কখনো ফিরবে না—এ কথা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে ৯ বছর বয়সী মেয়ে উমাইমান আঞ্জুম সিনহা।

নাতি-নাতনির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন দাদি খুরশিদা বেগম। কেউ সান্ত্বনা দিতে গেলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মোয়াজ্জেম চতুর্থ। তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে পুরো পরিবারকে আগলে রেখেছিল। এখন কে দেখবে এই পরিবারকে? কে সবাইকে একসঙ্গে আগলে রাখবে?’

স্বামীকে হারিয়ে নিজের বাক্‌শক্তিই যেন হারিয়ে ফেলেছেন জেসমিন আক্তার। সবার থেকে দূরে একটি কক্ষে মাটির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে তিনি। আজ মোয়াজ্জেমের তখন ময়নাতদন্ত চলছে।

যা ঘটেছিল

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে নগরের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে রাসায়নিকবাহী একটি লরির সংঘর্ষ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তেলবাহী ওয়াগনটি সল্টগোলা ক্রসিং পার হওয়ার সময় রাসায়নিক পদার্থবাহী একটি লরি রেললাইনে উঠে যায়। এ সময় ওয়াগনের ধাক্কায় রাস্তায় কাত হয়ে যায় লরিটি। নিচে পড়ে যায় লরিতে থাকা কনটেইনার। এ সময় কাস্টমস মোড় থেকে সিমেন্ট ক্রসিংমুখী সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। রাত ১২টার দিকে কনটেইনারের নিচ থেকে মোটরসাইকেলসহ মোয়াজ্জেমের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

চট্টগ্রাম ইপিজেড ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার এ কে এম রায়হান আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধারকাজের জন্য ভারী সরঞ্জাম না থাকায় সঙ্গে সঙ্গে লরিটি সরানো সম্ভব হয়নি। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্রেন দিয়ে লরিটি সরানো হয়।

কেউ সান্ত্বনা দিতে গেলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন মোয়াজ্জেমের মা খুরশিদা বেগম
কেউ সান্ত্বনা দিতে গেলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন মোয়াজ্জেমের মা খুরশিদা বেগমছবি: জুয়েল শীল

ক্রসিংয়ে নেই প্রতিবন্ধক, নিয়ন্ত্রণ করেন গেটম্যান

এই রেললাইনের ক্রসিংয়ে কোনো প্রতিবন্ধক (সিগন্যাল বার) নেই। নেই কোনো সিগন্যাল বাতি। তবে গেটম্যান থাকেন। তাঁরা হাতের ইশারা দিয়ে কাজ সারেন।

গতকাল ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা গেটম্যান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছিলেন, সংকেত দেওয়ার পরও লরির চালক থামেননি। এর ফলে সংঘর্ষ হয়।

গত ৬ এপ্রিলও একই রুটে তেলবাহী ওয়াগন ট্রেনের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) তারেক মুহাম্মদ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, এই রেললাইন দিয়ে শুধু তেলবাহী ওয়াগনই চলাচল করে। এগুলোর গতি ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের নিচে থাকে। ট্রেনের গতি অত্যন্ত কম থাকায় সেখানে গেটম্যানরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। ট্রেনের কম গতির এই সুযোগটাই মূলত গাড়ি চালকেরা নেন। তাঁদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ মানসিকতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সংকেত দিলেও তাঁরা তা অমান্য করেন। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মামলা করেছে পরিবার

শুক্রবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে কথা হয় নিহত মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাই নূর হোসেন ও শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তাঁদের দাবি, অব্যবস্থাপনার কারণেই তাঁদের ভাইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। নূর হোসেন বলেন, ‘সল্টগোলা ক্রসিং চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ও একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ একটি মোড়। এর আগেও এখানে দুর্ঘটনা হয়েছে। তাহলে কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না? আমরা এর সঠিক বিচার চাই।’

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে মোয়াজ্জেমের বড় ভাই
 শাহাদাত হোসেন (বায়ে)
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে মোয়াজ্জেমের বড় ভাই শাহাদাত হোসেন (বায়ে)ছবি: প্রথম আলো

নিহতের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন দুর্ঘটনার পরই ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘লরিটিতে যে রাসায়নিকের কনটেইনার ছিল, সেটি ভালোভাবে বাঁধা হয়নি। ফলে যখন ধাক্কা লাগে, সেটি লরি থেকে পড়ে যায়। কনটেইনার ঠিকভাবে না বাঁধায় প্রাণ হারাতে হয়েছে মোয়াজ্জেমকে।’

এ ঘটনায় শুক্রবার সকালে রেলওয়ে থানায় লরির চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেন নূর হোসেন। রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক আবু জাফর খান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই লরির চালক পালিয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হয়েছে। দ্রুত তাঁকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হবে।’

বেলা দেড়টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে নিহতের পরিবার ও রেলওয়ে পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *