এবার সবচেয়ে কম দল সংসদে, ২৩ দলের কেউ জেতেনি

২৩ দলের কেউ জেতেনি, এবার সবচেয়ে কম দল সংসদে

রাজনীতি

স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার পর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদে ১৩টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এরপর ষষ্ঠ সংসদ বাদে সব সংসদেই প্রতিনিধিত্ব ছিল ছয় থেকে নয়টি দলের। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩ দলের কোনো প্রার্থী ভোটে জিততে পারেননি। ফলে দ্বাদশ সংসদে মাত্র পাঁচটি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দল নির্বাচন বর্জন করে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের পর সবচেয়ে বেশি জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা—৬২টি আসনে। বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১১টি আসনে।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকার নির্বাচনকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক দেখাতে ভোটে দলের সংখ্যা বাড়াতে সচেষ্ট ছিল। তবে এসব দলের অধিকাংশেরই কোনো জনসমর্থন নেই। অতীতের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, এবার অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ দলেরই সংসদে কখনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না।

বেসরকারি ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩টির প্রার্থীরাই কোনো আসনে জিততে পারেননি। এসব দলের দু-একজন বাদে প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সর্বশেষ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভোট পেয়েছিল ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এই তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া যেসব আসনে জাতীয় পার্টি লড়েছে, সেখানে তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। এর বাইরে ভোটে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোর সবারই ভোট পাওয়ার হার নগণ্য।

প্রার্থী অনেক, তবে ভোটে ভরাডুবি

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩৫ জন প্রার্থী ছিল নতুন নিবন্ধিত দল তৃণমূল বিএনপির (সোনালী আঁশ প্রতীক)। চতুর্থ সর্বোচ্চ ১২২ জন প্রার্থী ছিলেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (আম প্রতীক)।
অন্যান্য দলের মধ্যে বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৭৯, জাসদের ৬৬, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ৬৩ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ৫৬ জন করে প্রার্থী ছিলেন।

এসব দলের কোনো প্রার্থী নির্বাচনে জিততে পারেননি। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এসব দলের প্রার্থীরা ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়তে পারেননি; বরং আলোচনায় থাকা কিছু নেতাও বড় ব্যবধানে ধরাশায়ী হয়েছেন। কোনো আসনে জয় না পাওয়া দলগুলোর প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে। এসব দলের অনেক প্রার্থীই ১০০ ভোটের কম পেয়েছেন।

দলের প্রতিনিধিত্ব কমেছে

নব্বইয়ের গণ–অভ্যুথানের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৭৫টি দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন ২ হাজার ৭৮৭ জন। সংসদে ১৩টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পায়। আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি (জাপা) ৩৫, জামায়াতে ইসলামী ১৮, সিপিবি ৫, বাকশাল ৫, জাসদ (সিরাজ) ১, ইসলামী ঐক্যজোট ১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, এনডিপি ১, গণতন্ত্রী পার্টি ১, ন্যাপ (মোজাফফর) ১ ও অন্যান্য দল তিনটি আসন পায়। প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ভোটের পর জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে।

বিএনপি সরকারের অধীনে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ রক্ষায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন হয়। প্রায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে। এই সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন।

এরপর বিরোধী দলগুলোর দাবির মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি যুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৮১টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন ২ হাজার ৫৭৪ জন।

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৬টি আসন। সংসদে ছয়টি দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বিএনপি ১১৬, জাপা ৩২, জামায়াতে ইসলামী ৩, ইসলামী ঐক্যজোট ১ ও জাসদ (রব) ১টি আসন পায়। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে।

২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৪টি দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯৩৯ জন।

ভোটে বিএনপি ১৯৩টি আসন পায়। আওয়ামী লীগ ৬২, জামায়াতে ইসলামী ১৪, জাপা ১৪, বিজেপি ৪, জেপি (মঞ্জু) ১, ইসলামী ঐক্যজোট ২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬টি আসন পান। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৮টি দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৫৬৭ জন। ভোটে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি ৩০, জাপা ২৭, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জামায়াতে ইসলামী ২, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ১, বিজেপি ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি আসনে জেতেন।

দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপিসহ নিবন্ধিত ২৮টি দল এই নির্বাচন বর্জন করে। মাত্র ১২টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়।

ভোটে আওয়ামী লীগ ২৩৪ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। জাপা ৩৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাসদ ৫, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ২, জেপি ২ ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ১টি আসন পায়। প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৪০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনটি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ছিল।

ভোটে আওয়ামী লীগ ২৫৮ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি পায় ৬টি আসন। জাপা ২২, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩, গণফোরাম ২, জাসদ ২, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ২, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ১, জেপি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসন পায়। সর্বশেষ সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল ৯টি দলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *