মত বদলাচ্ছে বিএনপির সমমনারা

রাজনীতি
সরকারের পতন চেয়ে আন্দোলনরত দলগুলোর অনেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এত দিন বিএনপির সঙ্গে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে থাকা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বে তিন দলের জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ গতকাল বুধবার নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আরো কয়েকটি দলকে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করার চেষ্টা চলছে।

নির্বাচনবিএনপির সমমনা দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, আন্দোলনের এই পর্যায়ে সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত দলগুলোর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণায় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বেশ পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।

 

সমমনা দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানান, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদল ও নির্বাচনে জিতে আসার সম্ভাবনা থাকায় তাঁরা মত পাল্টিয়েছেন। যুক্তফ্রন্টে আরো কয়েকটি দল যুক্ত হতে পারে। বিএনপির আন্দোলনের জোটসঙ্গী গণতান্ত্রিক মঞ্চের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা বেশ কয়েক দিন ধরে কর্মসূচিতে অনুপস্থিত। ওই নেতাকে নিয়েও নানা ধরনের গুঞ্জন আছে।

 

জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও গতকাল দুপুরে নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এত দিন তারা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে অস্পষ্টতা রেখেছিল। যদিও গত সোমবার থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে দলটি। দলটি বলেছে, তারা কোনো জোটে যাবে না।

এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। 

এত দিন ধরে ৩৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে যুগপত্ আন্দোলন করছিল বিএনপি। এর মধ্যে সৈয়দ ইবরাহিমের দলকে নিয়ে বিএনপির মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস ছিল। এখন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার আন্দোলনের মাঠে অনুপস্থিতি, কারো কারো হঠাত্ আড়াল হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও নানা আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুই দিন আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও জোট শরিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের শঙ্কা নিয়ে আলোচনা হয়।

তবে ওই দলগুলোকে নির্বাচনবিমুখ রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন নেতা বৈঠকে ধারণা দিয়েছিলেন যে এই সরকারের অধীনে কেউ নির্বাচনে যাবে না। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে কিছু ‘কিংস পার্টি’ গঠন করে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আলোচনা-গুঞ্জন আছে। এরই ধারাবাহিকতায় তৃণমূল বিএনপিসহ কয়েকটি দলে বিএনপির কয়েকজন সাবেক নেতা যোগ দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা রাজনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন। ফলে দলের নেতাদের নিয়ে এখনো তেমন অস্তিত্ব সংকটে পড়েনি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী কয়েক দিন খবুই গুরুত্বপূর্ণ। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় পার হলে রাজনৈতিক দৃশ্যপট অনেক পরিষ্কার হবে। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগমুহূর্ত পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর তৎপরতা থেকেই ছোট ছোট নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত দলের কদর বেড়েছে। এ জন্য বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নানাভাবে নির্বাচনে যেতে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর ফলে বিএনপির সমমনাদের নিয়ে একটি জোট গঠনের ঘোষণা এসেছে। আরো কয়েকটি দলও একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে যুক্ত হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও যুগপত্ আন্দোলনে গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ। জনগণ এটাকে রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে। এই জোট সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।

যুক্তফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ, বিশ্বাঘাতকতা বলল ১২ দল

সরকার পদত্যাগে ‘এক দফা’ দাবিতে যুগপত্ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোটের সঙ্গ ত্যাগ করে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি তিনটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। একই সঙ্গে নতুন জোট দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণাও দেয়।

গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এই নতুন জোট ও নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। যুক্তফ্রন্টের দলগুলো হলো বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন)। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি জোটের বাইরের দল।

ইবরাহিম বলেন, ‘আমি এখান থেকে বেরোনোর পর ৫০০ কমেন্ট এখানে আসবে বিশ্বাসঘাতক, দালাল, বেচা হয়ে গেছে। কিন্তু মেজর জেনারেল ইবরাহিম (বীরপ্রতীক) বেচা যাওয়ার পাত্র নন। আপনাদের কাছে আবেদন করব, এটা ধৈর্য পরীক্ষা। দেখুন কী হয়, কী করি।’ তিনি বলেন, ‘আমার এই মুহূর্তে রাজনৈতিক অক্ষমতা, আর তো পেরে উঠছি না এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এটা একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে ২৮ অক্টোবরের পরে। আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমি নিশ্চুপ থাকব নাকি আমি বিকল্প একটা পন্থা অবলম্বন করব। আমি বিকল্প অবস্থানটা নিলাম এই মর্মে যে আমি চেষ্টা করি, আমার এই কথাগুলো বলার আর জায়গা নেই আর কোনোখানে…সেটা যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কবুল করেন পার্লামেন্টে বলার।’

ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের বিশেষ এক মুহূর্তে ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ স্লোগানে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। নতুন এই ফ্রন্ট গঠনের আগে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সর্বশেষ জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে ১২ দলীয় জোট ছিলেন।

সৈয়দ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি ও জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর বাংলাদেশ মুসলিম লীগ নির্বাচনে যাওয়ায় তাঁদের ১২ দলীয় জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গতকাল জোটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১২ দলীয় জোট বলেছে, দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকারকে আগুনে নিক্ষেপ করে ইবরাহিম বিশ্বাসঘাতক ও বেঈমানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ইবরাহিম চলে যাওয়ায় জোটের নতুন মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবেন এলডিপি একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম।

আরো যাদের নিয়ে গুঞ্জন

নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদ, জাগপা, এনডিপিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বিভিন্ন মহল আলোচনা চালাচ্ছে। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আগ্রহী করতে সরকারসংশ্লিষ্ট কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও বৈঠক করছেন। মঙ্গলবার সৈয়দ ইবরাহিমের বাসায় বৈঠকেও এই দলগুলো ছিল। তবে গণ অধিকার ও এনডিপি নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অংশ নেবে না বলে জানায়।

গতকাল হরতালের সমর্থনে বিজয়নগর পানির ট্যাংকের মোড়ে এক সমাবেশে নুরুল হক নুর তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, সরকার রাজনীতির মাঠে আজ কোরবানির হাট বসিয়েছে। এই কোরবানি হাটে রাজনীতিবিদরা গুরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন। নুর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পঁচাত্তরের বাকশালী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৪ আর ১৮ সালের নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। জনগণের ভোটের অধিকার নেই, নির্বাচনের পরিবেশ নেই।

এনডিপি সভাপতি আবু তাহের ও মহাসচিব আবদুল্লাহ আল হারুন গতাকল এক বিবৃতিতে বলেন, যারাই বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার সহযোগিতা করবে, তারাই হবে জাতীয় বেঈমান এবং তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা গতকাল অবরোধের সমর্থনে মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে হুমকি-ধমকি ও লোভ-লালসা দিয়ে বিরোধী শিবির থেকে দু-চারজন নেতাকর্মীকে ভাগিয়ে নির্বাচনে নেওয়ার অপচেষ্টা করে সরকারের শেষরক্ষা হবে না।

জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও ছয় ইসলামপন্থী দল

বিএনপির সঙ্গে সরাসরি যুগপত্ আন্দোলনে না থাকলেও রাজনীতির মাঠে এখন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন তাদের সমমনা। সরকারের বিরুদ্ধে এই দুই দল আন্দোলন করছে। নিবন্ধিন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট। তবে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে।

ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচনে যাওয়ার কোনো পরিবেশ নেই।

এ ছাড়া লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনে যাবে না বলে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে জামিয়া নুরিয়া আশ্রাফাবাদে অনুষ্ঠিত সমমনা ইসলামী দলগুলোর সভায় নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করে সমমনা ছয়টি ইসলামপন্থী দল। তারা বলছে, এই মুহূর্তে দেশে নির্বাচনের কোনো পরিবেশও নেই।

সভায় উপস্থিত ছিলেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজীবুর রহমান হামিদী, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আজীজুল হক ইসলামাবাদী ও জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *